ঢাকা বিভাগ: ইতিহাস, ঐতিহ্য ও উন্নয়নের ধারাবাহিকতা
ঢাকা বিভাগ বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক বিভাগ। এটি দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে বিবেচিত হয়। ঢাকার ইতিহাস, ভূগোল, অর্থনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, পর্যটন এবং জনসংখ্যাগত বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, কেন এই বিভাগটি বাংলাদেশে একটি অগ্রণী স্থান দখল করে আছে। নিচে ঢাকা বিভাগের একটি বিস্তারিত বর্ণনা প্রদান করা হলো:
১. ভৌগোলিক অবস্থান ও আয়তন
ঢাকা বিভাগ বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় অংশে অবস্থিত। এটি পূর্বে ছিল বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিভাগ, কিন্তু ২০১৫ সালে ময়মনসিংহ বিভাগ পৃথক করার পর এর আয়তন কিছুটা কমে যায়। ঢাকা বিভাগের পূর্বে চট্টগ্রাম বিভাগ, পশ্চিমে রাজশাহী ও খুলনা বিভাগ, উত্তরে ময়মনসিংহ বিভাগ এবং দক্ষিণে বরিশাল বিভাগ ও বঙ্গোপসাগর অবস্থিত।
ঢাকা বিভাগের মোট আয়তন প্রায় ৩১,০৫০ বর্গ কিলোমিটার। এর মধ্যে নদী, খাল, বিল ও জলাশয় বিশাল একটি অংশ জুড়ে রয়েছে। বৃহৎ নদীগুলোর মধ্যে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ধলেশ্বরী, শীতলক্ষা ও বুড়িগঙ্গা উল্লেখযোগ্য।
২. জেলা ও প্রশাসনিক কাঠামো
বর্তমানে ঢাকা বিভাগে ১৩টি জেলা রয়েছে:
১. ঢাকা
২. নারায়ণগঞ্জ
৩. মুন্সিগঞ্জ
৪. গাজীপুর
৫. টাঙ্গাইল
৬. কিশোরগঞ্জ
৭. মানিকগঞ্জ
৮. নরসিংদী
৯. রাজবাড়ী
১০. ফরিদপুর
১১. মাদারীপুর
১২. গোপালগঞ্জ
১৩. শরীয়তপুর
ঢাকা বিভাগে রয়েছে অনেক উপজেলা, পৌরসভা, ইউনিয়ন ও গ্রাম, যা সমন্বিতভাবে বিভাগটির প্রশাসনিক কাঠামো গঠন করে।
৩. রাজধানী ঢাকা শহর
ঢাকা বিভাগে অবস্থিত বাংলাদেশের জাতীয় রাজধানী ঢাকা শহর। এটি শুধু বাংলাদেশের নয়, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ শহর। ঢাকা শহর প্রশাসনিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, শিক্ষাগত ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র।
ঢাকা শহরে জাতীয় সংসদ ভবন, রাষ্ট্রপতির বাসভবন বঙ্গভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, মন্ত্রীপরিষদ ভবন, সুপ্রিম কোর্ট এবং প্রায় সব সরকারি ও বেসরকারি গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর রয়েছে। ঢাকা শহরকে বলা হয় 'মসজিদের শহর', এখানে অসংখ্য প্রাচীন ও আধুনিক স্থাপত্যশৈলীর মসজিদ আছে।
৪. অর্থনীতি
ঢাকা বিভাগের অর্থনীতি বাংলাদেশের সবচেয়ে গতিশীল ও বৈচিত্র্যময়। গার্মেন্টস শিল্প, বস্ত্রশিল্প, নির্মাণ, তথ্য প্রযুক্তি, ব্যাংকিং, টেলিযোগাযোগ ও বাণিজ্য এখানকার প্রধান অর্থনৈতিক খাত।
বিশেষ করে গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও সাভারে গার্মেন্টস শিল্প ব্যাপক আকারে গড়ে উঠেছে। এগুলো দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে বড় অবদান রাখে। ঢাকা শহর হচ্ছে দেশের প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র যেখানে শত শত ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও কর্পোরেট অফিস রয়েছে।
৫. শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা
ঢাকা বিভাগ শিক্ষার দিক থেকেও দেশের শীর্ষে অবস্থান করছে। এখানে রয়েছে দেশের সবচেয়ে পুরনো ও স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেমন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ডি. ইউ. এস. টি, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি।
স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রেও এই বিভাগ শীর্ষে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (BSMMU), ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ, ও অনেক আন্তর্জাতিক মানের হাসপাতাল রয়েছে।
৬. সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য
ঢাকা বিভাগ সমৃদ্ধ সংস্কৃতির বাহক। এখানকার ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্য, লোকসংগীত, নৃত্য, পোশাক ও খাদ্য সংস্কৃতি বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক পরিচয় বহন করে। পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী নবাবী রীতিনীতি, ইফতার, মুঘলাই খাবার, এবং বারোয়ারি উৎসবগুলি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
নারায়ণগঞ্জকে বলা হয় "বাংলাদেশের ডান্ডি", কারণ এটি একসময় সুতা ও তাঁতের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মস্থান হওয়ায় রাজনৈতিক ইতিহাসেও এই জেলার গুরুত্ব অপরিসীম।
৭. ধর্ম ও জনসংখ্যা
ঢাকা বিভাগের প্রধান ধর্ম ইসলাম, তবে হিন্দু, খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরাও এখানে বাস করেন। এখানে বহু মসজিদ, মন্দির, গির্জা ও বিহার রয়েছে।
ঢাকা বিভাগ জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চল। ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে প্রতিদিনই জনসংখ্যা বাড়ছে, যার ফলে অবকাঠামোগত চাপে পড়ছে প্রশাসন।
বর্তমানে এই বিভাগের জনসংখ্যা প্রায় ৫ কোটি ৪০ লক্ষের বেশি (২০২৪-এর হিসাব অনুযায়ী)। জনসংখ্যার একটি বড় অংশ শহরকেন্দ্রিক, যা নগরায়ণের চিত্র তুলে ধরে।
৮. পর্যটন
ঢাকা বিভাগে পর্যটনের জন্য রয়েছে অনেক দর্শনীয় স্থান। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
-
লালবাগ কেল্লা
-
আহসান মঞ্জিল
-
সোনারগাঁও লোকজ জাদুঘর
-
জাতীয় স্মৃতিসৌধ (সাভার)
-
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস (বিশেষ করে শীতকালে পাখির আগমনে)
-
বালি কাটার দৃশ্য ও পাটের খামার (মুন্সিগঞ্জ, রাজবাড়ী অঞ্চলে)
-
বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল মিউজিয়াম (গোপালগঞ্জ)
এছাড়াও নদীভ্রমণ, পাড়াগ্রামের দৃশ্য ও ঐতিহ্যবাহী হাট-বাজার পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয়।
৯. চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
ঢাকা বিভাগের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো জনসংখ্যার চাপ, যানজট, দূষণ, বস্তি সমস্যা ও অপরিকল্পিত নগরায়ণ। ঢাকায় জলাবদ্ধতা এবং বায়ু দূষণ জনজীবনে বিরূপ প্রভাব ফেলছে।
তবে এই বিভাগের সম্ভাবনাও বিশাল। সঠিক পরিকল্পনা, পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন, অবকাঠামোগত সংস্কার এবং প্রযুক্তিনির্ভর শহর ব্যবস্থাপনা চালু করা গেলে ঢাকা বিভাগ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম উন্নত ও বাসযোগ্য অঞ্চল হিসেবে গড়ে উঠতে পারে।
উপসংহার
ঢাকা বিভাগ বাংলাদেশের প্রাণকেন্দ্র। এই বিভাগের ইতিহাস, সংস্কৃতি, অর্থনীতি এবং শিক্ষা ব্যবস্থা দেশের সমৃদ্ধির পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। নানা চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় ঢাকা বিভাগ ক্রমেই আধুনিক ও স্মার্ট বাংলাদেশের মডেল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে।